Sunday, July 2, 2017

মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট যেনো একটি অসভ্য ইতরের স্বর্গরাজ্য।



হাবিবুর রহমান মিছবাহঃ
২৮জুন'১৭ ইং হতে ৬জুলাই'১৭ ইং পর্যন্ত এক সপ্তাহ'র সফর ছিলো মালয়েশিয়ায়। কিছু ইসলামিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ও ভ্রমন উদ্দেশ্যই ছিলো এ সফরের। ২৮ জুন'১৭ ইং সন্ধা ৭.১৫ টায় বের হই বাসা হতে। যখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছি, তখন সময় রাত ৮টা। বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করি আনুমানিক রাত ৮.৩০ টার সময়। ইমিগ্রেশনে কর্তব্যরত অফিসারদের কাজের ধরণে ছিলো ধীরগতি। অন্যান্য সময় এমন দেরী হতে দেখিনি। হয়তো টেকনিক্যালী কোনো সমস্যা ছিলো। আমার ফ্লাইট রাত ১০টায়। ইউ এস বাংলা কর্তৃপক্ষ বার বার তাগিদ দিচ্ছিলো দ্রুত কাজ শেষ করার। তবে বোর্ডিং পাস পেয়ে যাওয়ায় ফ্লাইট মিস করার তেমন টেনশন ছিলো না আমার।

বিমান ছাড়ার ঠিক ১৫ মিনিট আগে ইমিগ্রেশন পার হই। এ সময় মালয়েশিয়ায় থাকা আমার খুব কাছের তিন বন্ধু, Ahmad Abdullah, Md Mostafa ও Prince Mohammad Monir ভাইর সাথে যোগাযোগ হয় এবং ফ্লাইটে ওঠা নিশ্চিত করি। আমার জানা মতে মনির ভাই ততোক্ষণে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন, আর আহমাদ আব্দুল্লাহ ভাইও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

কোনো ধরণের অসুবিধা ছাড়াই স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় কুয়ালালামপুর পৌঁছি। ইমিগ্রেশনে তেমন কোনো ভিড় ছিলো না। অন্য দেশের ফ্লাইটের যাত্রীও চোখে পড়লো বেশ। আমার সামনে থাকা চারজন বাঙালী ট্যুরিস্টকে ইমিগ্রেশন পার হতে না দিয়ে, কর্তব্যরত একজন মহিলা পুলিশ ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দিলো। মহিলা পুলিশটি জন্মসূত্রে নিশ্চয়ই মালাই নয়, তা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে জানতে পারি ওখানের ৯০ ভাগ কর্মকর্তা ইন্ডিয়ার কেরালা ও তামিলনাড়ূর লোক। এরপর একজন বাঙালী ট্যুর ইমিগ্রেশন পার হলো। এবার আমার পালা। হোটেল বুকিং, পাসপোর্ট ও আপডাউন টিকিট দেখে প্রশ্ন করলো মালয়েশিয়া কেনো এসেছি? বললাম ট্যুর। এক মিনিট কি যেনো ভাবলো মহিলা পুলিশটি। এরপর আমাকেও ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এখনো জানি না কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে।

অফিসে ঢুকলাম। বসতে বললো। বসলাম। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশটি আমার দিকে বিরক্তের সাথে বার বার তাকাচ্ছিলো। সেও একই ধরণের প্রশ্ন করলো, কেনো মালয়েশিয়া এসেছি। বললাম ট্যুর। এরপরের প্রশ্নটি আদৌ বুঝিনি। বললাম, সরি! প্লিজ এগেইন? কিন্তু উনি আর কিছুই বললো না। আমাকে পাশের অন্য একটি সীটে বসিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে এসে বললো, ওস্তাদ চলেন। আনন্দ লেগেছিলো এই ভেবে যে, ছেলেটি সম্ভবত বাঙালী। ও এখানে চাকরী করে, আর আমি হয়তো ইংরেজী জানি না তাই বাঙালী পুলিশ কর্তৃক আমাকে প্রশ্নোত্তর করাবে। আমিও মন খুলে সব কথা বলতে পারবো। কিন্তু পরে দেখলাম ছেলেটি বাঙালী নয়, হয়তো বাঙালীদের নিয়ে ওর কাজ, তাই দু’একটি বাংলা বলতে পারে।

একটি রুমে ঢুকানো হলো আমাকে। যেখানে ঢুকতেই ক'জন বাঙালী দেখতে পাই, যাদেরকে কান ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেশী ভাইদের এ অবস্থা দেখে মনে কতো বড় আঘাত পেয়েছিলাম তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। কিন্তু তখনো বুঝিনি কার সাথে কী হচ্ছে। আর আমার মনেও তেমন কোনা সংশয় ছিলো না। কেননা, আমার পাসপোর্ট ভারী। চারটি দেশের ভিসা লাগানো রয়েছে। আমার কাছে ডলার মওজুদ। হোটেল বুকিং ও আপডাউন টিকিট থাকায় ওরা আমাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না।

আমাকে চেক করা হলো। পাশেই আরেক বাঙালীকে একজন মহিলা চেক করছিলো। মহিলাটি ব্যঙ্গাক্তের সাথে বাঙালী লোকটির প্যান্ট খুলে গোপনাঙ্গ ধরে নাড়াচাড়া করছিলো এবং তা সবার সামনেই। আর অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা হো হো করে হেসে উঠলো তা দেখে। তখন কিছুটা আতংক তৈরী হয় আমার মনে। ফেসে যাচ্ছি না তো? এ তো দেখছি যথারীতি জাহেলী যুগের প্রত্যাবর্তন। মনে হলো এ যেনো মায়ানমারে মুসলিম নর-নারীর সাথে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সেই বিভৎস উল্লাস চলছে। কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনসহ মুসিলম বিশ্বে পশ্চিমা হায়েনাদের কবলে বন্দী অসহায় বাঙালীরা। ঐ রুমে ঢুকে একবারও মনে হয়নি আমি কোনো মুসলিম দেশে আছি। তবে তখনো আমি জানি না যে, আমাকে বন্দী করা হচ্ছে।

চেকিংকালে আমাকে ওভাবে লাঞ্ছিত করা হয়নি। আমার হাতে র‌্যাডো কোম্পানীর ঘড়ি ছিলো। ওটা দেখে হাসাহাসি করছিলো ওরা এ বলে যে, বাঙালী র‌্যাডোও ব্যবহার করে? মনে মনে বলছিলাম, বাঙালীরা তোদের মতো জানোয়ারদের কামলাও রাখে না। মোবাইল চাইলো। পকেট থেকে বের করে মোবাইলটি দিয়ে দিলাম। আমার মোবাইলটি আই ফোন সিক্স এস প্লাস। অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানের মতো হাসছিলো। হয়তো এবার ভাবছিলো বাঙালীদের আইফোনও থাকে! ওরা জানে না বাঙালীরা কতোটা সৌখিন ও ভদ্র। জানলে বাঙালীদের দূর হতেই সালাম করতো ওরা।

চেকিং শেষে মোবাইলসহ যাবতীয় জিনিসপত্র রেখে পাশেই আরেকটি রুমে ঢুকানো হলো আমাকে। সেখানে অনেক বাঙালী বসেছিলো। বেশ ক’জন আমাকে চিনেও ফেলে। খুব আফসোস করে একে অপরকে বলছিলো, দেখ হুজুরের মতো লোকটাকে এখানে আনলো ওরা। ওরা কি মানুষ? আমি তখনো বুঝিনি কী হচ্ছে এসব। আমি তখনো এটিই ভেবেছিলাম যে, এখানে কোনো কাজ আছে হয়তো। এখানের ফর্মালিটি সেরে তবেই আমাকে বের হতে দিবে।

সেই রুমে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ কর্মরত ছিলো। একেক করে বাঙালী ডাকছে আর টাকা চাচ্ছে। কেউ বলছে নেই। কেউ বলছে কম নিন। কেউ বলছে আমার সব হারিয়ে গেছে ইত্যাদি। আমি ভেবেছিলাম এ দু’জন পুলিশ সম্ভবত বাঙালী। চেহারায়ও তেমনটিই মনে হয়েছিলো। দু’জনই নিজ নিজ পোশাকে ছিলো। রাষ্ট্রীয় বা দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কোনো ইউনিফর্ম ছিলো না ওদের গায়ে। তবে ওদের ব্যবহার ছিলো কুত্তার চেয়েও খারাপ। ওরা বাংলা ভাষায় টাকা চায়, অথচ কোনো বাঙালী যদি বাংলায় বলে আমার কাছে নেই, তখন ওরা ইংরেজীতে বলতে হুকুম করে এবং তা ক্রোধের সাথে। আমার জীবনেও আমি এমন অসভ্য, ইতর ও অমানুষিক পরিবেশের সম্মুখীন হইনি। আমি তখনো জানি না যে, এসব বাঙালী জেল খেটে বাড়ী যাচ্ছে এবং ওদের কাছ থেকে খানার টাকা আদায় করা হচ্ছে।

সবশেষে আমাকে ডাকা হলো। বললো ১০০ ডলার দাও। আমি জানতে চাইলাম এটি কিসের টাকা। আমার সমস্যাটা কোথায়? আমাকে যদি সমস্যাই পোহাতে হয়, তাহলে মালাই এ্যাম্বাসী আমাকে ভিসা দিয়েছে কেনো? আমাকে এভাবে হয়রানি করার মানেটা কি? কথাগুলো হিন্দিতেই বলছিলাম। কেননা, এতোক্ষণে আমি জেনে গিয়েছি যে, ওরা মূলত ইন্ডিয়ার কেরালার লোক। তা ছাড়াও ওরা ফুল ভলিউমে তখন হিন্দি গান শুনছিলো। ওটাকে কোনো অফিসই মনে হয়নি। কখনো মনে হয়েছে বখাটে ছেলে-মেয়েদের গানের আড্ডাখানা, কখনো মনে হয়েছে হিংস্র জানোয়ারের আখড়া, কখনো মনে হয়েছে পিতৃ পরিচয়হীন কুত্তার বাচ্চাদের আস্তানা, আবার কখনো মনে হয়েছে ব্লু-ফিল্মের শুটিং স্পট।

কেননা, ওরা কাজ রেখে কখনো সেলফী তুলছে, কখনো গান ছেড়ে হাত-পা ছুড়ে নাচছে, কখনো শুধু শুধু বাঙালী কাউকে লাথি মেরে আনন্দ করছে, আবার কখনো কখানো মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে ছেলেটিকে সুড়সুরী দিচ্ছে। বাঙালীদের ওরা মানুষই মনে করে না। প্রত্যেক কথায় কথায় বাঙালীদের অপমান করে কথা বলছে ওরা। সাথে গালাগালি তো আছেই। ’হেই বাঙালী স্টুপিড কাম হেয়ার’, এভাবেই বাঙালীদের ডাকে ওরা। যদিও ইমিগ্রেশনের অফসিারদের এমন অভদ্র মনে হয়নি।

আমি কেনো হিন্দি বললাম, এজন্য ছেলেটি আমাকে প্রচুর গালাগালি করলো। আমি বললাম আমি ইংরেজী জানি না। কিন্তু আমার জানার অধিকার আছে আমি কেনো টাকা দিবো এবং কেনো আমাকে এতো হয়রানি করা হচ্ছে। এবার মহিলাটিও ক্ষেপে গেলো আমার উপর। ভাবলাম, অধিকার আদায়ের চেয়ে ইজ্জত রক্ষা করা দরকার। টাকা যা চায় দিয়ে বের হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম এ টাকা দিলে আমাকে ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়া হবে। আসলে ওরা টাকা চাচ্ছিলো আমি যে জেলে খাবো তার বিল। যাহোক, সরি বলে ১০০ ডলার পেশ করলাম। কিন্তু ওরা তা না নিয়ে মালাই ভাষায় কি যেনো বলাবলি করলো আর হাসলো। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে মহিলাটি চেয়ার থেকে উঠে অফিসার ছেলেটিকে সূড়সূড়ী দিতে শুরু করলো। আসলে কিভাবে উপস্থাপন করবো বুঝতে পারছি না। এক কথায় ওরা ওখানে তা তা করলো, স্থান নির্ধারণ না করে যেখানে সেখানে কুকুর যা যা করতে চায়। যদি সিসি ফুটেজ ওরা না মুছে থাকে, তাহলে আমার কথার প্রমাণ সিসি ক্যামেরায় নিশ্চয় পাবেন।

আমার উপর রেগে মহিলাটি কোথায় যেনো চলে গেলো। মিনিট দুয়েক পর একটি ছেলেকে নিয়ে এসে আমার ব্যাগটা নিতে বলে। ছেলেটি ইতস্ত করছিলো। আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে ছিলো। আমি ভেবেছি ছেলেটি সম্ভবত এখানেরই কোনো দায়িত্বরত কর্মচারী এবং বাঙালী। ও চাইছে না আমি বিপদে পড়ি। ওকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে যেতে বলা হলো। সাথে আমাকেও। ছেলেটি আমাকে ডাকলো। সাথে সাথে আমিও গেলাম। ভেবেছিলাম, সম্ভবত ওরা আমার থেকে ঘুষ না পেয়ে রাগ হয়ে ঘুষ না নিয়েই ওকে দিয়ে আমাকে ইমিগ্রেশন পার করে দিবে। আমি তখনো বুঝিনি কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে। কেননা, আমি ভাবতেও পারিনি বিনা কারণে আমার জেল হতে পারে।

ছোট একটি রুমের মধ্যে নিয়ে আমার ব্যাগে ট্যাগ লাগানো হলে আমি অনুমান করি আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না তো! এরপর আমাকে জুতা খুলতে বলা হয়। এবার ভেবেছি আমাকে কোনো শাস্তি দেয়া হচ্ছে সম্ভবত। অফিসারটিকে বার বার অনুরোধ করলাম, বললাম আমার সাথে আপনারা এমনটি করতে পারেন না। কিন্তু ব্যাগ বহনকারী ছেলেটি আমাকে অনুরোধ করতে নিষেধ করে। তখন আবার ভাবলাম হয়তো আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। টাকা নিয়ে ছেড়ে দিবে আমাকে। এবার রুম থেকে বের করে আমাকে আরেকটি রুমের দিকে নেয়া হয়। রুমটির দরজা খোলা হলো। ভেতরে তাকাতেই কলিজা শুকিয়ে গেলো। ভোর রাত। অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কেউ কাঁদছে, কেউ ঘুমোচ্ছে আর কেউ কেউ আমাকে দেখছে।

ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমি তখনো বুঝিনি এটি জেল। ভেবেছি, এখানে কিছুক্ষণ রেখে বের করে দিবে। ব্যাগ বহনকারী ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম আপনি কতো বছর চাকরী করেন এখানে? এবং আমাদের এখানে কেনো আনা হলো? ছেলেটি আমাকে বললো, এদিকে আসুন! একটি চেয়ারে বসিয়ে বললো, আমি এখানের কর্মচারী নই। আমাকেও বন্দী করা হয়েছে। ওর চেহারায় আতংকের ছাপ স্পষ্ট। তখন ছেলেটির উপর খুব রাগ হয়েছিলো আমার। কেননা, ও আমাকে অফিসারের কাছে অনুরোধ করতে নিষেধ করেছিলো। আমি ভেবেছিলাম অনুরোধ করবো এবং বেশী টাকার অফার দিয়ে বের হয়ে যাবো।

ছেলেটি বললো হুজুর ভুল বুঝবেন না! ওখানে টাকা দিলে ছেড়ে দেয় না। মূলত খানার টাকা রাখে। তবে সরকারীভাবে যতোটুকু বিল আছে, ওরা তার চেয়ে বিশী দাবী করে। বেশীটা ওদের ঘুষ। আর কোনো বিষয় অনুরোধ করলে ওরা মারধর করে। অতিরিক্ত  বাড়াবাড়ি করে ওরা। আমি চাইনি আপনার মতো লোক ওদের হাতে হেনস্থার স্বীকার হন। আটক করার কারণ জানতে চাইলে ছেলেটি বললো, আমিও কিছুক্ষণ আগে এসেছি, কিছুই জানি না। আমার প্রফেশনাল ভিসা। চার বছর পর দু'মাসের ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম। ছুটি শেষে এসেছি, কিন্তু আমাকে আটকে দিয়েছে।

আমি অযু করতে চলে গেলাম। অযু শেষে বের হতেই একজন ফিলিস্তিনি এগিয়ে আসেন আমার দিকে। বললেন, শায়খ সালাতুল ফজর। আমি আযান দিলাম। নামাযের ইমামতিও করলাম আমিই। খুন কান্না পাচ্ছিলো আমার। ওরা আমার সাথে এমন আচরণ করলো? এতোগুলো মানুষকে এভাবে আটক করে রাখলো? আমি বাঙালী বলে বাঙালীরা চাচ্ছিলো যেনো নামাযের পর একটু মুনাজাত করি। কিন্তু নামাযে যখন কেরাত পড়ছিলাম, তখন নামাযের মধ্যেই বাঙালীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই ইচ্ছা করেই নামায শেষে আর মুনাজাত করিনি। কেননা, মুনাজাতকালীন পরিবেশটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। নামায শেষে সাবইকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে ধর্যধারণ করে সবাই।

ইতোমধ্যে আরো ৭জন বাঙালীকে ঢুকানো হয় জেলখানায়। আমি নামাযের বিছানায়ই বসা ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। চুপচাপ বসে আছি। ভাবতে পারছিলাম না কী করবো। আর ভাবলেই বা কি? বাহিরের সাথে যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। ফিলিস্তিনি লোকটি পাশে এসে বসলো। বয়স আনুমানিক ৬০/৬৫ বছর হবে। শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর। কথা বার্তায় মনে হলো, লোকটি বড় মাপের আলেম হবেন নিশ্চয়ই। আমার আযান ও তিলাওয়াতের খুব প্রশংসা করলেন। আমি জানতে চাইলাম আপনি কতোদিন ধরে এখানে? তিনি বললেন ২৭ দিন। বললেন, এ দেশের পুলিশকে মানুষ বলা যায় না। আমার কোটি কোটি টাকার বিজনেস। অথচ, আমি এ দেশে অবৈধভাবে থেকে যাবো সন্দেহে আমাকে আটক করে রাখা হলো। সত্যি কথা বলতে আমি তখনো বুঝিনি সেটি জেলখানা এবং আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে জানতে পারি এটি জেলখানা এবং কে কোনদিন ছাড়া পাবে তার কোনো গ্যারান্টিও নেই।

কিছুক্ষণ পর পাশের একটি কক্ষে মহিলা ও বাচ্চাদের আওয়াজ পাই। বাচ্চাগুলো খুব কাঁদছিলো। জানতে পারলাম ওটি মহিলা লকআপ। বাচ্চাগুলো নাকি এভাবে সারাদিন ক্ষুধায় কান্নাকাটি করে। এ কথা শুনে আমার বাচ্চাদের কথা স্মরণ করে খুব কেঁদেছিলাম আমি। বাস্তবতা কেবল তখনই উপলব্ধি করতে পারি এবং বুঝতে পারি, আমার আর কিছুই করার নেই। আমি জেলখানায় বন্দি আছি। ভেবেছি কিভাবে খবর জানবে বাড়ীর মানুষ? স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা ও প্রিয়জন যখন খোঁজ-খবর না পাবে তখন তাদের কতোটা পেরেশানী হবে? এদিকে মনির ভাই, আব্দুল্লাহ ভাই ও মোস্তফা ভাই না জানি কতোটা দু:শ্চিন্তা করছেন। ঐ সময় তাদের কথা ভেবেই বেশী কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি। মানুষগুলো কতো কষ্টই না করেছে আমার জন্য।

কেউ ১মাস, কেউ ২০দিন, ১৫দিন, ১০দিন ধরে আটক রয়েছে সেখানে। ১সপ্তার নিচে কেউ ছাড়া পায় না। অবশ্য ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ এক/দু’দিনেও ছাড়া পেয়ে যায়। তবে তার উপর আশা করা যায় না। আর আমার তো মোটেই না। কেননা, সবাই বলছিলো আপনি তাদের সাথে তর্ক করতে গেলেন কেনো? ওদের সাথে কেউ তর্ক করলে তাকে একমাসেও ছাড়ে না। আর আপনি আজ যেভাবে তর্ক করলেন, তা অন্য কেউ করলে প্রচুর মারও খেতে হতো। ওরা পান থেকে চুন খসলেই প্রচুর মারধর করে। এই যে আপনি দাড়িয়ে আছেন, এসেই মারধর শুরু করবে আর বলবে এখানে দাড়িয়ে আছো কেনো? বসে থাকতে পারো না? বসে থাকবেন, বলবে সারাদিন বসে থাকো কেনো? হাটাচলা করতে পারো না? ঘুমাবেন, বলবে এতো ঘুম কিসের? এরকম যখন মন চায় ওরা এসে আমাদের এভাবে মারধর করে। আমাদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না এবং কথায় কথায় গালাগালি করে।

তবে পুরনো আটককৃত একজন বলেছিলেন, আপনার যেহেতু রিটার্ন টিকিট করা আছে, সেহেতু সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। যাদের রিটার্ন টিকিট নেই, তাদের দু:খের সীমা নেই। কেননা, টিকিট ছাড়া আপনি যাবেন কিভাবে? আর ওরা যে দেশের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবে, বিষয়টি এমনও নয়। বলবে টিকিট কর, কিন্তু যদি বলি যোগাযোগ করিয়ে দাও, তা দিবে না। ওরা যখন যা মন চায় তাই করে। কোনোভাবে নিজের কেউ খবর পেয়ে যদি টিকিট করে পাঠায়, তবেই ছাড়া পাওয়া সম্ভব। সুইপার মোবাইল নিয়ে আসে, এক মিনিট কথা বলতে বাংলাদেশী ১০০ টাকা নেয়। আবার কারো কাছে বেশী টাকা দেখলে তা জোড় করে নিয়ে যায়। অফিসাররা ভেতরে ঢুকে সিগারেট টানে। নারী-পুরুষ নষ্টামী করে। এমন কি নেশাও করে। আর আমাদের কেউ সেদিকে তাকালেও তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।

একজন পাকিস্তানী তাবলীগের মুরব্বীকে আটক করে ওরা, যার ছেলে মালয়েশিয়ান বড় একটি কোম্পানীর মালিক। প্রফেশনাল ভিসাধারী বেশ কয়েকজন বাঙালী ছিলো, যারা ৪-৫ বছর ধরে মালয়েশিয়া কাজ করছে। ছুটি কাটিয়ে কেবল বাংলাদেশ থেকে ফিরেছে। কিন্তু তাদেরকে বিমান থেকে নামতেই গ্রেফতার করেছে। পাশের রুমে আটক থাকা মহিলা ও শিশুদের কান্নাকাটিতে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিলো। নিয়ত করে ফেললাম, মানসিকভাবে একটু স্বাভাবিক হলে সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করবো। যতোদিনই বন্দী থাকি না কেনো, এখানের সব অনিয়মগুলো নোট করবো আমি। যাতে বিশ্ব দরবারে ওদের গাদ্দার তুলে ধরতে পারি। এরমধ্যে চারজন বাঙালীকে নিশ্চিত করা হলো, তাদেরকে আজকের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে পাঠানো হবে। একজন এগারো দিন ও আরেকজন পাঁচদিন পর ছাড়া পাচ্ছে। আর বাকী দু'জনেরটা সঠিক খেয়াল নেই। তারা খুব খুশি এবং অন্যরা তাদের কাছে প্রিয়জনদের নাম্বার দিচ্ছিলো যাতে মুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ওখানে ঢুকালে আপনার প্রিয়জনের জানার সুযোগ নেই যে, আপনি কোথায় আছেন। বিষয়টি এমন নয় যে, আপনাকে গ্রেফতার করে আপনার পরিচিত কাউকে জানানো হয়। একেক করে চারজনের নাম ধরে ডাকলো নতুন এক মহিলা পুলিশ। কারতালীয়ভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার নামটিও উচ্চারণ করলো। সাংবাদিকতা আর করা হলো না। তবে যতোটুকু ঘটেছে বা দেখেছি, ততোটুকু তো পৃথিবীকে জানাবোই। ২৯জুন'১৭ ইং স্থানীয় সময় বিকাল পাঁচটার ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্সে আমাকেসহ আরো চারজনকে ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে।

ওরা যাকে তাকে সন্দেহ করে। তবে বাংলাদেশীদের একেবারেই ছোট নজরে দেখে ওরা। বর্তমানে নাকি মালয়েশয়িায় যতো অবৈধ লোক আছে, তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয়েছে বৈধ হওয়ার। ফলে এই সুযোগে বাঙালীরা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ব্যাপকহারে মালয়েশিয়া ঢুকছে। আমার কথা হচ্ছে, যদি বিষয়টি এমনই হয়, তাহলে তো দু’মাসের জন্য বাঙালীদের জন্য মালয়েশিয়ান ভিসা বন্ধ করে দিলেই হতো! ভিসা দিয়ে এগুলো কোন ধরণের ফাজলামো? হাজার হাজার মানুষ টাকা খরচ করে সেখানে কি তাদের ফাজলামো দেখতে যায়? এরপরও প্রয়োজনে সন্দেহজনক ব্যক্তির পেছনে গোয়েন্দা নজরদারি করা যেতে পারে! পাইকারী হারে এমন হয়রানির মানে কি? শুনেছি এর আগে নাকি বাংলাদশের সচিব পর্যায়ের একজন ব্যাক্তিকেও তিনদিন আটক করে রাখা হয়েছিলো।

আমাদের সাথে এমন এমন বিজনেসম্যান ছিলেন, যাদের মালয়েশিয়াতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একজন তো মালাই ভাষাও জানেন, বিবাহ করেছেন মালয়েশিয়ায়, পাসপোর্টে অনেকগুলো দেশের ভিসা লাগানো, তবুও তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এরকম অসংখ্য সম্মানী লোকদের ওরা বন্দী করে রেখেছে। যতো মানুষ আটক করেছে, কারোরই ভিসা পাসপোর্ট বা অন্য কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা ওরা সন্দেহ করেছে। আচ্ছা কাউকে সন্দেহ করলে তো তাকে যাচাই করা যায়! যাচাইতেও সন্দেহ থেকে গেলে তখন না হয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু যাচাই ছাড়া কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে এভাবেই হেনস্থা করা হচ্ছে বাঙালী নাগরিকদের। তাদের সন্দেহ দূর করতে আপনি যে কিছু বলবেন, সে সুযোগও দিচ্ছে না ওরা। শুধুমাত্র সন্দেহ’র উপর ভিত্তি করে প্রমাণ ছাড়া এভাবে হেনস্থা করার রাইট আছে তাদের? শুনেছি একদিনে ৯০০ বাঙালীকে আটক করা হয়েছে শুধু এই সন্দেহ’র ভিত্তিতে। অনেককে এমন পেয়েছি, যাদেরকে বিমান থেকে নামার সাথে সাথেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব বিষয় বাংলাদেশ সরকারের এখনি ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশকে এভাবে ছোট করে দেখার অধিকার কারো নেই।

হ্যা, এটিও সত্য যে, কিছু বাঙালীরা ট্যুর ভিসা নিয়ে সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাচ্ছে। আমাদের সাথে থাকা বাঙালীদের মধ্যে অধিকাংশই অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার জন্যই ট্যুর ভিসা করে মালয়েশিয়া গিয়েছে। লজ্জা হয় তাদের জন্য। কেউ কেউ তো একবার ধরা খেয়ে আবার এসেছে। কিন্তু কেনো? আপনি এ পথ কেনো বেছে নিচ্ছেন? গেলে বৈধভাবে যান, নাহয় দেশে পরে থাকেন? দেশে যারা আছে তারা কি না খেয়ে থাকে? আর এর পেছনে যে সমস্ত দালালগোষ্ঠী কাজ করছে, তাদেরকেও বা সরকার দমন করছে না কেনো? প্রায় সময়ই এই দালালগোষ্ঠীর নানা ধরণের ফাঁদ ও প্রতারণার খবর শুনে থাকি মিডিয়ার মাধ্যমে। কই, সমস্যার নিরসন হচ্ছে না তো? যারা অবৈধভাবে অন্য দেশে যেতে চাচ্ছেন, মূলত তারাও বাংলাদেশের শত্রুদের অংশীদার। তাদের কারণেই অন্যদেশে আমার দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অনুরোধ করে বলছি, আপনারা অবৈধভাবে বিদেশে যাবেন না। প্লিজ, দেশে রিক্সা চালান, দিন মজুরী কাজ করুন, চানাচুর বিক্রি করুন, তবুও এ অবৈধ পথ বেছে নিবেন না। দেশের বদনাম করবেন না আপনারা। কাঁদাবেন না নিজের স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবাসহ প্রিয়জনদের।

সরকারে প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী আদম ব্যবসায়ী নামক দালালদের দমন করুন! কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করুন এ নরপিচাশদের। সাথে সাথে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়ান। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এ দেশে জায়গার অভাব নেই। নেই বুদ্ধির অভাবও। বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপিরা যদি দুর্নিতিবাজ না হতেন, তাহলে এ দেশের কোনো একটি নাগরিকদের বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝড়াতে হতো না। এখনি পদক্ষেপ নেয়ার সময়। বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে আমার দেশের নাগরিকদের আমার দেশেই কাজ করার সুযোগ করে দিন। আমরা ভিনদেশের গোলামী করতে চাই না। বরং, বাংলাদেশই হবে অন্যান্য দেশের সমীহ জাগানো দেশ।

সবশেষে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, যতো দেশে গিয়েছি, বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনে থাকা পুলিশদের আচরণের মতো কোনো দেশের পুলিশদের আচরণ পাইনি। তাদের ব্যবহার দেখলে সত্যিকারের সেবক মনে হয় তাদেরকে। পরামর্শ নেয়া যায়। সুযোগ-সুবিধা দেখেন। পরামর্শ দেন। সমস্যা হলে সমাধানের পথ বাতলে দেন। বিশেষ করে বিদেশী নাগরিকদের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মেহমানসূলভ ব্যবহারের তুলনাই হয় না। এরপর কতো যাত্রীকে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখি, কিন্তু তারা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে সেবা দিয়ে যান। যদিও দু'একজন ব্যতিক্রম থাকতে পারে। অথচ, অন্যান্য দেশে বাংঙালীদের মেহমান নয়, কামলা হিসেবে দেখে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া। না দিবে পরামর্শ। না শুনবে আপনার কথা। না করবে মূল্যায়ন। আপনাকে মানুষই করবে না ওরা। মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই ওদের মধ্যে। তবে এর জন্য কিছুটা দায়ভার আমরাও এড়াতে পারবো না। পারবে না দেশের সরকারও। তারা দেশে কর্ম সংস্থান না বাড়িয়ে, দুর্নীতি বন্ধ না করে, দালালদের প্রশ্রয় দিয়ে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমনে গিয়ে দেশের জন্য ভিক্ষা চায়। লজ্জা হওয়া উচিত আমাদের।

বিশেষ পরমার্শ : বিমানে ওঠার পর থেকে যাদের প্রিয়জনের কোনো খোজ খবর পাচ্ছেন না, তারা দ্রুত মালয়েশিয়ায় বসবাসরত কোনো পরিচিতজনকে দিয়ে ইমিগ্রেশন লকআপে খবর নেয়ার ব্যবস্থা করুন। আর যারা মালয়েশিয়ার ভিসা করে ট্যুরে যাওয়ার নিয়ত করেছেন, তাদের ট্যুর ক্যান্সেল করে এক/দু’মাস পরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। বর্তমানে ইমিগ্রেশন হতে পাইকারী হারে বাঙালীদের গ্রেফতার করছে মালাই পুলিশ। কাউকে কাউকে ইমিগ্রেশনে যাবার পূর্বেই। অনেকেই সেখানে প্রচুর কষ্ট পাচ্ছেন। প্রচন্ড এসির ঠান্ডা, বিছানাহীন, দুর্গন্ধযুক্ত পানি, অরুচিকর খাবার ইত্যাদিতে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। চিকিৎসার ব্যাবস্থাও করা হচ্ছে না সেখানে। তাই নতুন করে কেউ বিপদে পড়তে যাবেন না। রিস্ক না নেয়াই ভালো হবে।

মালয়েশিয়া পুলিশ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে করা আমার বিশেষ প্রতিবেদন...

No comments:

Post a Comment